ইতিহাস, ঐতিয্য ও ভ্রমন বিষয়ক লেখক:
১৭৮৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক সিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাজধানী হয়। নিউইয়র্ক সিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম শহর। শহরটি নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত এবং এক সময় এই রাজ্যের রাজধানী ছিল। এমনকি এই শহরটি এক সময় সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ছিল। একে শুধু নিউইয়র্ক নামেও ডাকা হয়ে থাকে। বর্তমান বিশ্বে নিউইয়র্ক সিটি অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা কেন্দ্র। বিশ্বব্যাপী এর রাজনীতি, মিডিয়া, বিনোদন, ফ্যাশনের প্রভাব বিশেষ উল্লেখযোগ্য। জাতিসংঘের সদর দপ্তর এখানে অবস্থিত যার কারণে একে আন্তর্জাতিক কূটনীতির তীর্থস্থান বলা যায়। এই শহরে বসবাসকারীদেরকে নিউইয়র্কার বলা হয়।
১৫২৪ সালে ইতালীয় অভিযাত্রিক গিওভান্নি ডা ভেরাজ্জানো’র হাত ধরে যখন ইউরোপীয়রা প্রথম এই অঞ্চলটি আবিষ্কার করে তখন এই শহরাঞ্চলটিতে ৫০০০-এর মত স্থানীয় আমেরিকান লেনাপদের বসতি ছিল যাদেরকে রেড ইন্ডিয়ান বলা হয়ে থাকে। ইতালির এই অভিযাত্রিক ফরাসি রাজার আনুগত্য ও পৃষ্ঠপোষকতায় এই আবিষ্কার করেছিলেন। আবিষ্কারের পর তিনি এই অঞ্চলের নাম দেন “নৌভেলে এঙ্গোলেমে” তথা নতুন এঙ্গোলেমে। এখানে প্রথম ইউরোপীয় বসতি স্থাপন শুরু হয় যখন ওলন্দাজরা ১৬১৪ সালে ম্যানহাটনের দক্ষিণ প্রান্তে একটি পশম ব্যবসার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। তারা পরবর্তিতে এই স্থানের নাম দেয় “নতুন আমস্টারডাম”।
ওলন্দাজ উপনিবেশের পরিচালক পিটার মেনুইট ১৬২৬ সালে ম্যানহাটন দ্বীপটি স্থানীয় লেনাপদের কাছ থেকে কিনে নেন। কিংবদন্তী রয়েছে, ম্যানহাটন মাত্র ২৪ মার্কিন ডলার মূল্যে বিক্রিত হয়েছিল, যদিও এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ১৬৬৪ সালে ব্রিটিশরাশহরটি দখল করে নেয় এবং এর নতুন নাম দেয় নিউ ইয়র্ক। তারা ইংল্যান্ডের ইয়র্ক এবং আলবানির ডিউকের নামানুসারে এই শহরের নাম রেখেছিল। অ্যাংলো-ওলন্দাজ যুদ্ধের শেষে ওলন্দাজরা রান দ্বীপের কর্তৃত্ব পাওয়ার শর্তে নতুন আমস্টারডামের কর্তৃত্ব বিট্রিশদের হাতে ছেড়ে দেয়। তখন রান দ্বীপের গুরুত্বই বেশি মনে হয়েছিল। ১৭০০ সাল নাগাদ শহরাঞ্চলে লেনাপ গোষ্ঠীয় জনসংখ্যা কমতে কমতে ২০০-তে এসে দাড়ায়।
ব্রিটিশ শাসনের অধীনে নিউইয়র্ক সিটি বন্দর নগরী হিসেবে প্রভাব অর্জন করে। ১৭৫৪ সালে নিম্ন ম্যানহাটনে কিংস কলেজ নামে একটি বিদ্যাপীঠ স্থাপিত হয় ব্রিটেনের রাজা জর্জ ২-এর বিশেষ অনুমোদন সাপেক্ষে। এই কলেজটি ছিল কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রূপ। মার্কিন বিপ্লবী যুদ্ধের সময় এই শহরে বেশ কিছু ছোটখাটো যুদ্ধ সংঘটিত হয় যেগুলোকে একত্রে বলা হয় নিউইয়র্ক ক্যাম্পেইন। মহাদেশীয় কংগ্রেস এই নিউইয়র্ক সিটিতেই একসাথে মিলিত হয়েছিল এবং ১৭৮৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি মনোনীত করেছিল। প্রথম রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটনের অভিষেক হয় এই শহরের ওয়াল স্ট্রিটে স্থাপিত ফেডারেল হলে। ১৭৯০ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্ক সিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ছিল।
নিউ ইয়র্ক ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য শহরগুলো একটি নির্দিষ্ট কাউন্টির ক্ষুদ্র অঞ্চল জুড়ে অবস্থান করে। কিন্তু নিউইয়র্ক শহরটি নিজেই পাঁচটি পৃথক পৃথক কাউন্টি নিয়ে গঠিত। এই কাউন্টিগুলোকে বরো বলা হয়। শহরটি একসময় মূলত ম্যানহাটন বরো নিয়েই গঠিত ছিল যা হাডসন এবং ইস্ট রিভারের মাঝের একটি দ্বীপে জুড়ে অবস্থিত। ১৮৯৮ সালে আশেপাশের বেশ কয়েকটি সম্প্রদায় এই শহরের অন্তর্ভুক্ত হয় যেগুলো অন্য চারটি বরো গঠন করেছে। এগুলো হল: কুইন্স, ব্রুকলিন, ব্রঙ্ক্স এবং স্টেটেন দ্বীপ। একমাত্র ব্রঙ্ক্স যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূমিতে অবস্থিত, বাকি চারটি বারো-ই জলবেষ্টিত। ম্যানহাটন এবং স্টেটেন দ্বীপ পানি দ্বারা সম্পূর্ণ বেষ্টিত এবং কুইন্স ও ব্রুকলিন লং দ্বীপের অন্তর্ভুক্ত।
কুইন্স: পাঁচটি বরোর মধ্যে কুইন্স বৃহত্তম যার সর্বমোট আয়তন ২৮২.৯ বর্গ কিমি (১০৯.২ বর্গ মাইল)। এটি লং দ্বীপের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত, ব্রুকলিন থেকে নিউটাউন খাঁড়িএবং দ্বীপের অন্যান্য শহর থেকে ইস্ট রিভার ও লং আইল্যান্ড সাউন্ড দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। এটি দক্ষিণে আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এবং পূর্বে নাসাউ কাউন্টির সীমানা নির্দেশ করে। ২০০০ সালের তথ্য মোতাবেক এই বরোর জনসংখ্যা ২,২২৯,৩৭৯। পাঁচটি বরোর মধ্যে এই সংখ্যা দ্বিতীয়, প্রথম ব্রুকলিন।
ব্রুকলিন: এটি নিউইয়র্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং সবচেয়ে জনবহুল বরো। লং দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। ম্যানহাটন থেকে আপার বে এবং ইস্ট রিভার পার হয়ে এখানে আসতে হয়। মোট আয়তন ১৮২.৯ বর্গ কিমি (৭০.৬ বর্গ মাইল) এবং ২০০০ সালের তথ্যমতে মোট জনসংখ্যা ২,৪৬৫,৩২৬। এর জনসংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের যেকোন একক শহর থেকে বেশি, অবশ্য সমগ্র নিউইয়র্ক শহর বা লস অ্যাঞ্জেল্স ও শিকাগো শহর ধরলে এটি চতুর্থ হয়ে যায়। ১৮৯৮ সালের আগে এটি যখন পৃথক মিউনিসিপ্যালিটি ছিল তখন এটি যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহৎ শহর ছিল।
স্টেটেন দ্বীপ: তৃতীয় বৃহৎ বরো এবং এর জনসংখ্যা সবচেয়ে কম। এটি আপার ঊর্ধ্ব নিউইয়র্ক বে এবং নিম্ন নিউ ইয়র্ক বে’র সংযোগস্থলে অবস্থিত। ভৌতভাবে এটি প্রধানত নিউ জার্সির বেশি কাছে অবস্থিত। নিউ জার্সির সাথে চারটি সেতুর মাধ্যমে এটি যুক্ত। নিউইয়র্ক সিটির সাথে এর সংযোগ সাধন করে কেবল ভেরাজানো-ন্যারোস সেতু এবং বিখ্যাত স্টেটেন দ্বীপ ফেরী। এর মোট আয়তন ১৫১.৫ বর্গ কিমি (৫৮.৫ বর্গ মা)। সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত এই বরোর জনসংখ্যা ২০০০ সালের তথ্য মোতাবেক ৪৪৩,৭২৯ যা পুরো শহরের জনসংখ্যার শতকরা মাত্র ৫ ভাগ।
ব্রঙ্ক্স: চতুর্থ বৃহৎ এবং সর্ব উত্তরের বরো। কেবল এই বরোটিই আমেরিকার মূল ভূমিতে অবস্থিত। অবশ্য এর তিন দিকেও রয়েছে পানি। তিন দিকের জলাশয়গুলো হল পূর্বে লং আইল্যান্ড সাউন্ড, দক্ষিণে হারলেম ও ইস্ট রিভার এবং পশ্চিমে হাডসন নদী। সর্বমোট আয়তন ১০৯ বর্গ কিমি (৪২ বর্গ মা) এবং ২০০০ সালের তথ্য মোতাবেক মোট জনসংখ্যা ১,৩৩২,৬৫০।
ম্যানহাটন: পাঁচটি বরোর মধ্যে ক্ষুদ্রতম। এর অপর নাম নিউইয়র্ক কাউন্টি। মূলত ম্যানহাটন দ্বীপ নিয়ে গঠিত হলেও গভর্নর্স দ্বীপ, রান্ডাল্স দ্বীপ, ওয়ার্ডস দ্বীপ, রুজভেল্ট দ্বীপ, উথান্ট দ্বীপ এবং মার্বল হিল (ব্রঙ্ক্স’র মূল ভূমির প্রান্তে অবস্থিত একটি এনক্লেভ) এই শহরের অন্তর্ভুক্ত। মোট আয়তন ৫৯.৫ বর্গ কিমি (২৩ বর্গ মা) এবং ২০০০ সালের তথ্য মোতাবেক মোট জনসংখ্যা ১,৫৩৭,১৯৫। ১৯১০ সালে এই শহরের জনসংখ্যা ছিল ২.৩ মিলিয়ন যা ১৯৮০ সাল নাগাদ কমে গিয়ে ১.৪ মিলিয়নে দাঁড়ায়। এরপর কিছুটা বেড়েছে। ম্যানহাটনই মূলত নিউ ইয়র্ক শহরের প্রাণ। এখানেই এর বিখ্যাত সব গগনচুম্বী দালানের অধিকাংশ অবস্থিত যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে এম্পায়ার স্টেট দালান (১৯৩১), ক্রিস্লার দালান (১৯৩০) এবং সিটিকর্প সেন্টার (১৯৭৭)। ১০১ তলা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দালান যুগল এই দ্বীপেই অবস্থিত ছিল। নিউ ইয়র্কের নগরায়িত অঞ্চলের মধ্যে এটিই সবচেয়ে প্রাচীন, ঘন এবং সুগঠিত।
আতা মোহাম্মাদ উবায়েদ
ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ভ্রমন বিষয়ক লেখক
obayed.roni@gmail.com